একটা সময় ছিলো,যখন পুরো পৃথিবীর মোবাইল ফোন বাজারের ২০% ছিলো ব্লাকবেরির দখলে।প্রায় সবার হাতেই তখন ছিলো ব্লাকবেরি ফোন।২০০৭ সাথে তাদের নেট ইনকাম গিয়ে দাঁড়ায়, ৬৩১ মিলিয়ন ডলার।কর্পোরেট জব হোল্ডারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে সবার উপরে ছিলো ব্লাকবেরি।কারণ এমন কিছু সুবিধা ব্লাকবেরিতে ছিলো, যা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান তার গ্রাহকদের দিতে পারতো না।ব্লাকবেরিকে তখন 'স্মার্টফোনের রাজা' বলে ডাকা হতো।কিন্তু কয়েক বছর পরেই তাদের শেয়ার প্রায় ০% এ নেমে আসে।একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের ৫০% বাজার দখলে রাখা এই প্রতিষ্ঠানটির উত্থান-পতন নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা।

প্রতিষ্ঠানের সূচনাঃ ব্লাকবেরির শুরু মূলত মাইক এবং ডগলাস নামে দুজন কানাডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারের হাত ধরে।তারা RIM(Research in motion) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন।১৯৮৪ সাথে তৈরি হওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি প্রথমদিকে GM এর জন্য LED system  এবং IBM এর জন্য Local network প্রজেক্টে কাজ করে। ১৯৯৬ সালে তারা প্রথম Two-way পেজার বাজারে ছাড়ে।যেটি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে টেক্সট বা ভয়েজ পাঠাতে বা রিসিভ করতে পারতো।ধাপে ধাপে এই পেজারে কালার ডিসপ্লে,ইন্সট্যান্ট মেসেজিং,ওয়াইফাই এবং ওয়েব ব্রাউজিংয়ের মতো সুবিধাগুলো যোগ হয়।Blackberry 850 মডেল দিয়ে তারা এই ব্রান্ডের প্রথম পেজার নিয়ে আসে।এটির সুবিধা ছিলো, যেকোন স্থান থেকে চাইলেই ইমেইলে এক্সেস নেয়া যেতো।এই প্রযুক্তি ছিলো তখনকার তুলনায় বেশ অগ্রসর। 

  

                                                        Blackberry 850 


ব্লাকবেরির উত্থানঃ ২০০২ সালে তাদের প্রথম মোবাইল ফোন Blackberry 5810 বাজারে আসে।এই ফোনটি বাজারে আসার সাথে সাথেই পেজার বা ল্যাপটপের বিকল্প হিসেবে এটির নাম উঠে আসে।কারণ কী-বোর্ড এবং অন্যান্য ফিচারগুলোর কারণে খুব সহজেই মেইল ব্যবহার করা যেতো। তখনকার সময় ব্লাকবেরির সিকিউরিটি ছিলো খুবই ভালো। যেকোন হ্যাকারের জন্য ব্লাকবেরির OS হ্যাক করা কষ্টসাধ্য ছিলো।ফোনের মধ্যেই ডেটা ট্রান্সফারের ক্ষেত্রেও আরো কিছু সিকিউরিটি দেয়া ছিলো। তখন ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য খুবই কম ব্যান্ডউইথ ছিলো। কিন্তু ব্লাকবেরি এমন প্রযুক্তি নিয়ে আসে যার মাধ্যমে নেটওয়ার্ক ওভেলর ছাড়াই ডেটা ট্রান্সমিশন করা যেতো।তাই অন্যান্য কম্পানির তুলনায় ব্লাকবেরির কল কোয়ালিটি ছিলো চোখে পড়ার মতো।BBM নিয়ে আসার মাধ্যমে ব্লাকবেরি সবার উপরে উঠে আসে।তখন ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো কম্পানিগুলো ছিলনা।তাই ব্লাকবেরি যখন ঘোষণা দেয়, BBM এর মাধ্যমে কোন প্রকার মেসেজ লিমিট বা চার্জ ছাড়াই যোগাযোগ করা যাবে,সবার কাছ থেকে তারা ভালো সাড়া পায়।তখনকার সরকারি কাজগুলো এবং বাণিজ্যিক চুক্তিগুলোও তারাই পেত।ফলে ২০০৭ সালে তাদের রাজস্ব গিয়ে দাঁড়ায় ৩ বিলিয়ন ডলার।  

 


Blackberry 5810
 

পতনের কারণঃ 

১. Ignoring touchscreen: যখন অ্যাপলের মতো ব্রান্ডগুলো পুরোপুরি টাচস্ক্রীনের দিকে এগুচ্ছিল,তখনও ব্লাকবেরি তাদের 'Qwerty keyboard' ব্যবহার করছিলো। বর্তমানে আমরা টেক্সট পাঠানোর ক্ষেত্রে ইমোজি,স্টিকার,ভয়েজ- টাইপিং এর মতো হাজার হাজার কাজ করি,যা চাইলে ব্লাকবেরিতে সম্ভব ছিলনা।টাচস্ক্রীনের প্রতি তাদের এই উদাসীনতাকে তাদের পতনের অন্যতম কারণ মনে করা হয়।

২. খারাপ ডিজাইনঃ শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও ব্লাকবেরির ডিজাইন ছিলো সমস্যাজনক । নিজেদের  কী-বোর্ড ধরে রাখার কারণে ফোনগুলোর ওজন দিন দিন বাড়ছিলো। অপরদিকে কী-বোর্ড ব্যবহার করার কারণে তারা তাদের টাচস্ক্রীন খুব একটা বড় করতে পারছিলো না।ফলে মানুষ ব্লাকবেরির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে।Blackberry priv এবং Blackberry KEYone এই ধরনের সমস্যাগুলোর অন্যতম উদাহরণ।    

৩. BBM ধরে রাখার জেদঃ BBM প্রথমদিকে অল্প বয়সী গ্রাহকদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করতো।তাই নরমাল টেক্সট ব্যবহার না করে সবাই BBM এর ফিচারগুলোই ব্যবহার করতো।কিন্তু অন্যান্য কম্পানির ডিভাইসে এটি ব্যবহারের সুযোগ না দেয়ার গ্রাহক সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে।পরবর্তীতে তাদের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে চাইলেও,ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে।    

৪. ব্লাকবেরি OS: যেকোন অ্যাপ ফোনে ইন্সটল করার ক্ষমতা থাকার কারণে বর্তমানে যে কোন অ্যাপস্টোর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাপ ডেভলপারদের প্রথম থেকেই ব্লাকবেরি OS এর প্রতি আগ্রহ ছিলো কম।কারণ অ্যান্ডোয়েড জগতে তারা তখন নতুন ছিলো।যার ফলে অন্যান্য অ্যাপস্টোরের তুলনায় এখানে খুব কম অ্যাপ পাওয়া যেত।এখনো ব্লাকবেরি ফোনগুলোতে ফেসবুক বা টুইটার ব্যবহার করা কষ্টসাধ্য কাজ। 

৫. কর্পোরেট মার্কেট হারানোঃ প্রথম থেকেই দুই ধরনের মার্কেট ছিলো ব্লাকবেরির।অল্প বয়সীরা BBM এর কারণে এবং ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ফিচাররের কারণে।এর প্রধানতম কারণ  ছিলো, ব্লাকবেরির ছিলো খুবই ভালো সিকিউরিটি ব্যবস্থা, যেটি বর্তমানেও বিদ্যমান।কিন্তু প্রতিনিয়ত আপডেট হওয়া এই সেক্টরে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি তারা । তাছাড়া ভারত,পাকিস্তানের মতো কিছু কিছু দেশে একটা সময় সরকারের সাথে তাদের সমঝতার অভিযোগ উঠে আসে,যারা ফলে তারা গ্রাহকদের তথ্য  শেয়ার করতে বাধ্য হয়।যদিও ব্ল্যাকবেরি প্রথম থেকেই এটা অস্বীকার করে আসছে।

৬. প্রতিযোগিতার অবমূল্যায়নঃ বাকি কম্পানিগুলো যখন নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে গ্রাহকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল,ব্লাকবেরি তখনও শুধুমাত্র তাদের আগের ফিচারগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছিল। যে কম্পানিটি সবার চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলো,তারা চাইলে সফল হতে পারতো।কিন্তু তারা অনেক পিছিয়ে পড়ে,যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব ছিলোনা। উদাহরণ হিসেবে যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ ১৯ বিলিয়নের উপর বিজনেস করছে, সেখানে BBM কে তারা উন্মুক্ত করেনি।যখন কিনা সবাই এই প্রযুক্তির জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য ছিলো।  


একসময়ের প্রতাপশালী ব্লাকবেরি এভাবেই তাদের মার্কেট হারায়। অ্যাপল হেডফোন জ্যাক বাদ দেয়ার পর অনেকেই বিরক্ত ছিলো কিন্তু এখন এটি ফিচারে পরিণত হয়েছে।যখন মার্কেট তাদের দখলে ছিলো, তাদেরও এমন পদক্ষেপগুলো নেয়ার দরকার ছিলো।তাহলে হয়তো আজকে আমরা ব্লাকবেরিকে একটা সফল কম্পানি হিসেবে জানতাম।ব্লাকবেরির এই ভুলগুলো থেকে কিছু শিক্ষা নিতে পারি আমরা। যেমনঃ আমরা যদি নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিয়মিত নিজেদের আপডেট না করি তাহলে আমরা পিছিয়ে পড়বো।প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে।ব্লাকবেরির ভুলগুলো ব্যক্তিজীবনে শিক্ষা হিসেবে কাজে লাগুক সবার।